বাংলাদেশে সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ: একটি গভীর বিশ্লেষণ

By Rakib
বাংলাদেশে সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ: একটি গভীর বিশ্লেষণ

বাংলাদেশে সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ: একটি গভীর বিশ্লেষণ

বাংলাদেশে সাংবাদিকতা পেশা আজ নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক পাঁচটি দেশের একটি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই তথ্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং দেশের গণতন্ত্র ও অভিব্যক্তি স্বাধীনতার জন্য হুমকিস্বরূপ।

বর্তমান পরিস্থিতি

বাংলাদেশে সাংবাদিকদের উপর হামলা, হুমকি এবং হয়রানির ঘটনা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে যারা সরকার বিরোধী সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন, তাদের উপর চাপ বাড়ছে। অনেক সময় সাংবাদিকদের মামলার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, এমনকি কারাবরণও করতে হচ্ছে। এছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার করে সাংবাদিকদের ভয় দেখানো হচ্ছে।

গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকজন প্রখ্যাত সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ায় দণ্ডমুক্তির সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে। ফলে অনেক সাংবাদিক নিজেদের সেন্সর করছেন বা পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। এটি দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতার জন্য বড় হুমকি।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। স্বাধীনতা আন্দোলনে সাংবাদিকদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তখন থেকেই সত্য প্রকাশের জন্য অনেক সাংবাদিক জীবন বিপন্ন করেছেন। কিন্তু বর্তমানে সেই ঐতিহ্য ধরে রাখা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি সাংবাদিকরা পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। সেই সময় অনেক সাংবাদিক শহীদ হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সামরিক ও সামরিক-বেসামরিক সরকারের আমলেও সাংবাদিকরা সত্য প্রকাশের চেষ্টা করেছেন।

১৯৯০-এর দশকে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে কিছুটা স্বাধীনতা এসেছিল। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে আবার পরিস্থিতির অবনতি শুরু হয়। বিশেষ করে ২০১৮ সালের পর থেকে সাংবাদিকদের উপর চাপ ক্রমশ বেড়েছে।

সাংবাদিকদের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ
১. শারীরিক নিরাপত্তার অভাব

সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো শারীরিক নিরাপত্তার অভাব। বিশেষ করে যারা দুর্নীতি, রাজনৈতিক অনিয়ম বা পরিবেশ বিষয়ক সংবাদ করেন, তারা প্রায়ই হুমকি ও হামলার শিকার হন। অনেক সময় এসব হামলার পিছনে থাকে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী বা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।

উদাহরণস্বরূপ, ২০১২ সালে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড, ২০১৫ সালে অভিজিত রায় ও অন্যান্য ব্লগার হত্যাকাণ্ড, ২০১৮ সালে বিশিষ্ট ফটো সাংবাদিক শাহিদুল আলমের কারাবরণ - এসব ঘটনা সাংবাদিকদের নিরাপত্তাহীনতার চিত্র তুলে ধরে।

২. আইনি হয়রানি

সরকার বিরোধী প্রতিবেদন প্রকাশ করলে অনেক সময় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। বিশেষ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে অনেক সাংবাদিককে হয়রানি করা হচ্ছে। এই আইনের ৫৭ ধারায় অস্পষ্ট ভাষায় "রাষ্ট্রদ্রোহিতা" এর অভিযোগ এনে সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা হয়।

প্রখ্যাত সাংবাদিক প্রবীর সিকদার, শাফিকুর রহমান কাজল প্রমুখ এই আইনে হয়রানির শিকার হয়েছেন। এছাড়া অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের মতো পুরনো আইনও ব্যবহার করা হচ্ছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে।

৩. আর্থিক চাপ

সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া বা ব্যবসায়িক চাপ সৃষ্টি করে অনেক সময় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়। এতে সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে লিখতে পারেন না। অনেক সময় চাকরি হারানোর ভয়ে নিজেদের সেন্সর করেন।

৪. ডিজিটাল নিরাপত্তার অভাব

অনলাইন হ্যাকিং, সাইবার হুমকি ইত্যাদির কারণে অনেক সাংবাদিক ডিজিটাল মাধ্যমে নিরাপদ বোধ করেন না। তাদের ইমেইল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদি হ্যাক করা হয়। এতে তথ্যসূত্রের গোপনীয়তা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে।

৫. স্ব-সেন্সরশিপ

উপরোক্ত কারণগুলোর জন্য অনেক সাংবাদিক নিজেদের সেন্সর করতে বাধ্য হন। তারা সংবেদনশীল বিষয়ে লিখতে ভয় পান। এতে সত্য প্রকাশ ব্যাহত হয় এবং জনগণের তথ্য জানার অধিকার ক্ষুণ্ন হয়।

আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির তুলনা

বাংলাদেশের পাশাপাশি যেসব দেশে সাংবাদিকতা ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সিরিয়া, ইয়েমেন, মেক্সিকো ও আফগানিস্তান। এসব দেশের সাথে বাংলাদেশের অবস্থানের তুলনা করলে দেখা যায়:

সিরিয়া ও ইয়েমেনে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে সাংবাদিকরা চরম ঝুঁকির মধ্যে কাজ করেন। সেখানে সরাসরি প্রাণনাশের ঝুঁকি বেশি।

মেক্সিকোতে ড্রাগ কার্টেল ও সংগঠিত অপরাধীদের কারণে সাংবাদিকরা হুমকির মুখে থাকেন।

আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের কারণে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা প্রায় নেই বললেই চলে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই ধরনের চরম পরিস্থিতি না থাকলেও, ক্রমাগত অবনতি হওয়ায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করছে। বিশেষ করে সরকার কর্তৃক সাংবাদিকদের উপর চাপ প্রয়োগ এবং আইনের অপব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।

সরকারের অবস্থান

সরকার অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। তাদের বক্তব্য হলো, বাংলাদেশে সংবাদ মাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে এবং কোনো সাংবাদিককে তার পেশাগত কাজের জন্য হয়রানি করা হয় না। সরকারের মতে, যারা আইন ভঙ্গ করেন শুধু তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

তবে সরকারের এই দাবির সাথে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন। কারণ প্রায়ই দেখা যায়, সরকার সমালোচনামূলক প্রতিবেদনকে "মিথ্যাচার" বা "বিভ্রান্তিকর তথ্য" হিসেবে অভিহিত করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে।

সুশীল সমাজের ভূমিকা

এই পরিস্থিতিতে দেশের সুশীল সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে:

সাংবাদিকদের উপর হামলার ঘটন